২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে মাথায় রেখে ঢেলে সাজানো হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। ‘সম্মেলনের অঙ্গীকার, রুখতে হবে জঙ্গিবাদ’ স্লোগানে আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। ওই সম্মেলনে যে নতুন কমিটি হবে সেই নেতাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোকে মোকাবিলা করাসহ চলমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে, এমনটি মাথায় রেখেই সম্মেলনে বড় ধরনের চমক দিতে চান দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিগত কাউন্সিলে পদ-পদবিতে উল্লেখযোগ্য রদবদল না হলেও এবার বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের আমলনামা এখন সভাপতির টেবিলে। তিনি এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন দলের নেতাদের বিগত দিনের কর্মকাণ্ড। এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে ছিটকে পড়তে পারেন হাইব্রিড, বিতর্কিত, হেভিওয়েটরাও যারা দুই দফা কেন্দ্রীয় কমিটিতে থেকেও সারা দেশে নিজের ইমেজ তৈরি করতে পারেননি। বেফাঁস কথাবার্তায় দলকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। জাতীয় নেতা হয়েও দলকে সুসংগঠিত করতে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফর তো দূরের কথা নিজ এলাকাতেই যাননি। সূত্র জানায়, মাঠের রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ সংগঠক, ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক ছাত্রনেতা, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দলের চরম দুর্দিনে যারা অবদান রেখেছেন তাদের কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এদিকে সম্মেলনের প্রস্তুতি, অতিথিদের উপস্থিতি, তাদের আপ্যায়ন ও গঠনতন্ত্র সংশোধন, ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের রূপরেখা, জঙ্গিবাদবিরোধী অঙ্গীকার, কমিটির আকার বৃদ্ধিসহ সবকিছুতেই বড় চমক দিতে চাইছেন শেখ হাসিনা।
সূত্রমতে, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটা বার্তা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, যাদের কারণে দল বিতর্কিত হয়েছে, যারা দায়িত্বশীল পদে থেকেও দলকে যথাযথভাবে সহযোগিতা করেননি, তাদের দলীয় পদ টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন হবে। উদাহরণ হিসেবে দলটির নেতারা জানিয়েছেন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের কাণ্ডারি ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া খুব চেষ্টা চালিয়েছিলেন মহানগরের কমিটিতে থাকার জন্য কিন্তু দলের হাইকমান্ড তাকে কোথাও রাখেনি। একইভাবে সদ্যঘোষিত কমিটিতে নেই খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম এবং তাদের অনুসারীরাও। গত মঙ্গলবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ৮১ করার পক্ষে মত দিয়েছেন নেতারা। একই সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির আকারও। কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেসিডিয়ামে দুটি, সাংগঠনিকে তিনটি পদ বাড়ছে। প্রশিক্ষণ সম্পাদকের পদ নতুন সৃষ্টি করা হচ্ছে। সভাপতি প্রধানমন্ত্রী এতে সম্মতি দিয়েছেন। এ ছাড়াও বিগত সংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে যেসব নেতার বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেগুলো প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন দলীয় সভাপতি। তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তারা দলকে দীর্ঘদিন সেবা দিয়েছে। সম্মেলন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় উৎসব। তারা এখানে অংশ নেওয়ার অধিকার রাখে। তাই তাদের শাস্তি প্রত্যাহার করতে হবে। বিদ্রোহীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের খবরে বহিষ্কৃতদের অনুসারীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনে ঢাকা-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ড. আওলাদ হোসেন গত সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় বহিষ্কার হন। গত মঙ্গলবার কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার হওয়ার সিদ্ধান্তে কদমতলী থানার আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নাছিম মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেনসহ আওলাদের পক্ষে শতাধিক নেতা-কর্মী গত দুই দিন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছেন। এদিকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই টেনশন বাড়ছে কেন্দ্রীয় ও পদপ্রত্যাশী নেতাদের। কী পদ পাবেন, আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে কি, নাকি হতাশা মিলবে— এমন নানা টেনশনে কাটছে তাদের প্রতিটি প্রহর। দলের বড় নেতাদের বিশেষ করে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন তাদের এই টেনশন আরও বেশি। প্রেসিডিয়াম, সম্পাদকমণ্ডলী পদে যারা আছেন, তারা স্বপদে থাকবেন, নাকি পদোন্নতি পাবেন না ছিটকে পড়বেন তারা এমন ভাবনায় উদ্বেল। কাউন্সিল প্রস্তুতির উপকমিটির নেতারা জানিয়েছেন, ইতিহাস সেরা সম্মেলন আয়োজনে জোর প্রস্তুতি চলছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। প্রস্তুতি কমিটির যৌথসভা থেকে নতুন সব ঘোষণা আসছে নিত্যই। এতে কমিটি গঠনের রূপরেখা থেকে শুরু করে কাউন্সিল ও অতিথিদের উপস্থিতি, তাদের আপ্যায়ন ও গঠনতন্ত্র সংশোধনসহ চমকপ্রদ সব তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র বলছে, টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সম্মেলন এবার ‘ভিন্ন ধাঁচের’ হবে। বিশেষ করে এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হবে— দেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এ জন্য সম্মেলনকে ঘিরে গতানুগতিক এজেন্ডার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চমক থাকবে। কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নেতারা জানান, এবারের সম্মেলন বিগত যে কোনো বারের চেয়ে জাঁকজমক ও তাত্পর্যপূর্ণ হবে। এতে কাউন্সিলরদের পাশাপাশি লাখো নেতা-কর্মী যেমন অংশ নেবেন, তেমনি আসবেন গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা। গুণগত পরিবর্তনও আসবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এ ছাড়া সম্মেলনে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের কমিটি সাজানো, ভবিষ্যৎ কার্যপদ্ধতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণ এবং দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রে সংযোজন-বিয়োজনের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।
দলীয় সূত্র বলছে, জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন হতে যাওয়া কমিটিতে ঠাঁই পাবেন নিষ্কলুষ ও কর্মঠ তরুণরা। শীর্ষ পদে উঠে আসবেন অধস্তন পদধারীরা। এ ক্ষেত্রে গত দুই কমিটিতে বাদ পড়া পুরনো ও অভিজ্ঞ নেতাদেরও শামিল করার চিন্তা রয়েছে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। তথ্যমতে, সম্মেলনে তিন ক্যাটাগরিতে নেতাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রথম কাতারে আছেন অনিয়ম-দুর্নীতি ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের দায়ে সমালোচিত নেতারা। দ্বিতীয় সারিতে রয়েছেন— বেফাঁস মন্তব্যকারীরা। যাদের বোলচালের জন্য দল ও সরকারকে সবসময়ই খেসারত দিতে হয়েছে। আর তৃতীয় স্তরে আছেন বয়সের ভারে নুয়েপড়া, শারীরিকভাবে অসুস্থ একাধিক নেতা যারা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অনেকটাই অক্ষম। জাতীয় নেতা হয়েও অনেকেই দলকে সুসংগঠিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। জেলা সফর করা তো দূরের কথা নিজ এলাকাতেও যাননি কেউ কেউ। কর্মীরাও কাছে পান না তাদের। দলের চেয়ে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এরাই বাদ পড়াদের তালিকায় প্রথমভাগে রয়েছেন। পৌরসভা ও ইউনিয়ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দু-একজন সাংগঠনিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে দলীয় সভাপতির কাছে। সে কারণে এবারের কাউন্সিলে তারা ছিটকে পড়তে পারেন।
দলটির দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সম্মেলনে শক্তি ও সামর্থ্য যথাযথভাবে প্রদর্শন করা হবে। তাই কাউন্সিলের ছয় মাসের বেশি সময় আগে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতির গতি প্রকৃতির দিকে নজর রেখে আগামী নেতৃত্বে দক্ষ, যোগ্য, ত্যাগী, পরিশ্রমী তরুণদের দেখতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ২০১২ সালের সম্মেলনে ওই পরিকল্পনা সফল হওয়ায় এবারের কাউন্সিলেও সেই চমক দেখানোর চিন্তাভাবনা করছেন তিনি।
পাঠকের মতামত: